ঢাকা ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৫:১২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০২৪
বাংলা সিলেট ডেস্ক: জেড আই খান পান্না বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চারবার নির্বাচিত সদস্য; মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্টের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য; আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন। আইন পেশায় চার দশকের বেশি সময় ধরে নিয়োজিত এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর জন্ম ১৯৪৮ সালে। সমকালের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
সমকাল: ১ নভেম্বর ২০০৭ সালে মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ইতোমধ্যে ১৭ বছর চলে গেল। আপনার দৃষ্টিতে বিচার বিভাগ কতটুকু স্বাধীন হলো?
জেড আই খান পান্না: বর্তমান প্রধান বিচারপতি তিন দিন আগে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটা রোডম্যাপ দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের সঙ্গে যুক্ত সবার মতামত নিয়ে তিনি তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি দ্রুত সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যত তাড়াতাড়ি তাঁর এ প্রস্তাব গৃহীত হবে, তত দ্রুত বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পথে এগোবে। এখন দেখার বিষয়, রোডম্যাপটি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার কতটা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
সমকাল: বিগত সরকার ছিল দলীয়। তাই তাদের নানা কায়েমি স্বার্থ দেখতে হতো। কিন্তু বর্তমান সরকার তো নির্দলীয়; গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবটি তারা নিশ্চয় ইতিবাচকভাবে নেবেন।
জেড আই খান পান্না: বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এটা বলেন। বাস্তবে কতখানি করবেন, দেখার বিষয়। কারণ এখনও কায়েমি স্বার্থ শুধু বহাল নেই, নানাভাবে দৃশ্যমান।
সমকাল: তাহলে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাব বাস্তবায়ন বিষয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
জেড আই খান পান্না: আমার আশাবাদ, নিরাশাবাদে খুব একটা যায় আসে না। বিষয়টি আশাবাদ বা নিরাশাবাদের নয়; সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে এটুকু বলা যায়, সরকারে আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের মতো তিনজন আইন অঙ্গনের লোক রয়েছেন। তারা হয়তো কিছু চেষ্টা করতে পারেন।
সমকাল: বিচার বিভাগ স্বাধীন করার পথে এখনকার বাধা কী বলে আপনি মনে করেন?
জেড আই খান পান্না: বাধা আর কিছু না; আমলাতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। লালফিতার দৌরাত্ম্যে যারা বিশ্বাস করেন, তারা।
সমকাল: ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহারের সময়ও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল।
জেড আই খান পান্না: হ্যাঁ, সেই সময় সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট রোকনুদ্দৌলার সেই প্রতিবাদের কথা নিশ্চয় আপনার মনে আছে। তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে বিচারিক ক্ষমতা রাখার বিষয়ে তিনি যে দাবি জানিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে আমার হয়ে আজকের অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে একটা পিটিশন দিয়েছিলেন।
সমকাল: এখনও সেই প্রশাসন ক্যাডারের বাধা ডিঙিয়ে সরকার বিচার বিভাগ স্বাধীন করার পথে কতটুকু এগোতে পারবে?
জেড আই খান পান্না: যদি সরকারের মানসিকতা এই হয়– যা কিছু হোক আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চাই, তাহলে ওই বাধা তারা ডিঙাতে পারবেন। নচেৎ এটা সম্ভব হবে না। এদিক থেকে আমি মনে
করি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য বাস্তবে বড় কোনো বাধা নেই; নীতিনির্ধারকদের মানসিকতাই হলো সমস্যা।
সমকাল: বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতাও তো গুরুত্বপূর্ণ।
জেড আই খান পান্না: বিচার বিভাগ যে রাজস্ব আয় করে, তা দিয়েই এ বিভাগ চলতে পারে। সরকারের কাছ থেকে বাড়তি কিছু নিতে হতো না। কিন্তু সেটাও সরকার ওই মানসিকতার কারণে দিচ্ছে না।
সমকাল: নিম্ন আদালতের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও উচ্চ আদালত তো অনেকটা স্বাধীন–
জেড আই খান পান্না: এটা সত্য নয়। বিগত সরকারের আমলে নানাভাবে উচ্চ আদালতেও হস্তক্ষেপ হয়েছে। এখনও আদালতের বাইরে জমায়েত করে উচ্চ আদালতের প্রশাসনিক বিষয় প্রভাবিত করার চেষ্টা চলেছে।
সমকাল: আপনি কি সম্প্রতি কয়েকজন বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে ছাত্রনেতাদের মিছিল নিয়ে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে যাওয়ার কথা বলছেন?
জেড আই খান পান্না: আমি শুধু বিচারপতিদের পদত্যাগ নয়; নিয়োগ নিয়েও কথা বলতে চাইছি। এই যে কিছুদিন আগে হাইকোর্টে ২৩ বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলো, সে সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, একজন শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা পর্যন্ত বলেছেন, নীতিমালা না করে নিয়োগ দেওয়া উচিত হয়নি।
সমকাল: সম্প্রতি ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউয়ের রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে আসায় নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ক জটিলতার অবসান ঘটবে?
জেড আই খান পান্না: সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে আসায় আমিও উল্লসিত। কিন্তু অপসারণের পরিস্থতিই যাতে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য বিচার প্রশাসনের সক্রিয়তা জরুরি।
সমকাল: বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে আগে থেকেই প্রধান বিচারপতির অনুমোদন নেওয়ার একটা রীতি আছে। সে ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
জেড আই খান পান্না: সেই অনুমোদন তো অলৌকিক অনুমোদন। এ ব্যাপারে বেশি কিছু না বলাই ভালো।
সমকাল: একটা আইন করার কথা ছিল এ বিষয়ে। বর্তমান সরকার তা করছে না কেন?
জেড আই খান পান্না: সরকার করছে না, কারণ তখন নিজেদের পছন্দমতো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
সমকাল: বিচার বিভাগ নিয়ে বর্তমান সরকার তো আগের সরকারগুলোর চেয়ে বেশি অঙ্গীকারবদ্ধ–
জেড আই খান পান্না: বর্তমান সরকার বলেছিল, মামলা হলেও তদন্ত ছাড়া গ্রেপ্তার করা হবে না। কিন্তু তদন্ত দূরের কথা, মামলা ছাড়াই গ্রেপ্তার চলছে। ব্যাকডেটেড মামলা হচ্ছে, এমনকি আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালে সংঘটিত ঘটনার জন্য এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশ কয়েকজন আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাটেরও কয়েকজনের নাম এ ধরনের মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকেও তো এক মামলায় ৯৪ নম্বর আসামি করা হয়েছিল।
সমকাল: উচ্চ আদালত কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব ক্ষেত্রে কিছু করতে পারেন না?
জেড আই খান পান্না: অবশ্যই করা উচিত। কারণ এগুলো মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে মামলা দেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত কী করবে?
সমকাল: আগে তো এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে আগাম জামিনের কথা আমরা শুনতাম।
জেড আই খান পান্না: আগাম জামিন সেশন কোর্টও দিতে পারেন। আমরা আগে এ ধরনের জামিনের জন্য সেখানেই যেতাম। আইনে সেশন কোর্টকে এ এখতিয়ার দেওয়ার কারণে ঢাকার বাইরের লোকদের আগাম জামিনের জন্য ঢাকায় আসতে হতো না। কিন্তু এখন সেশন কোর্ট সম্ভবত তা ভুলেই গেছে। এ ধরনের জামিন দিলেই বিচারক ঝামেলায় পড়েন। প্রমোশনের বদলে ডিমোশন তো আছেই।
সমকাল: তাহলে বিচারাঙ্গনকে বিগত সরকারের লিগ্যাসি থেকে বের করার কী হবে?
জেড আই খান পান্না: প্রধান বিচারপতি যথেষ্ট চেষ্টা করছেন, কিন্তু সরকার তাঁকে কি সহযোগিতা দিয়েছে? এই যে উনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কিছু প্রস্তাব দিলেন; কী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার এ বিষয়ে?
সমকাল: আপনারা আইনজীবীরাও তো এ বিষয়ে সম্মিলিত কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
জেড আই খান পান্না: এ অবস্থার জন্য দায়ী বিগত সরকার। নির্বাচনের নামে তারা যে উন্মাদনা দেখিয়েছে, তাতে আইনজীবীদের মধ্যে বিভক্তি চরমে। এ বিভাজনটা না থাকলে হয়তো বিচারাঙ্গনে আজকের পরিস্থিতিটা হতো না। হয়তো একদিন আইনজীবীরা আবার ঐক্যবদ্ধ হবেন, তবে এখন আমি এ বিষয়ে কোনো আশার আলো দেখছি না।
সমকাল: সবকিছু মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে বিচার বিভাগ কেমন থাকবে বলে মনে করেন?
জেড আই খান পান্না: শেষ পর্যন্ত ভালো হবে– এ আশা আমি পোষণ করি; যদিও বর্তমানে এ আশার স্থান নেই। আমার একটা আবেদন থাকবে সব দলের প্রতি– দিন শেষে তারাই তো রাষ্ট্র চালাবেন। তারা যেন বিচারপতি পদে দলের লোকদের বসালেও জ্ঞানী, সৎ, দেশপ্রেমিক, যোগ্য লোকদের বসান। তারা অন্তত এ ব্যবস্থাটা করবেন– এ বিচারপতিরা সম্পদের হিসাব দেবেন এবং অসততা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট বিচারপতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে।
সমকাল: আপনার আশাবাদের কারণ কী?
জেড আই খান পান্না: আশাবাদী হচ্ছি কারণ, অন্ধকারের পর তো আলোই আসে, তাই না?
সমকাল: ধন্যবাদ আপনাকে।
জেড আই খান পান্না: সমকালকে ধন্যবাদ।
সম্পাদকীয় কার্যালয় : আছমান ম্যানশন, কদমতলী সিলেট। নিউজ : ০১৬-৪২৫০৫৪৬৬
Design and developed by DHAKA-HOST-BD